আজান ও একামাতের সুন্নাত তারিকা কি?
আজানের মাসায়েল আজান দেওয়া কখন থেকে আরম্ভ হয়।
আজান ও একামাতের সুন্নাত তারিকা কি? হুজুর পাক (সঃ) মদীনা শরীফে হিজরত করে যাওয়ার পর সন এক হিজরী থেকে আজান দেওয়া আরম্ভ হয়। এর পূর্বে বিনা আজানেই নামাজ পড়া হত। কারণ এর পূর্বে মুসলমানদের সংখ্যা হেকে ডেকে একত্রিত করার মত অধিক ছিল না।
মদীনা শরীফে হিজরত করার পর দিন দিন মুসলমানদের সংখ্যা বৃদ্ধি পায়। তখন এমন এক ঘোষণার প্রয়োজন হয়ে পড়ে যা শুনে মুসলমানগণ বিভিন্ন স্থান হতে তাদের কাজ ছেড়ে একত্রিত হয়ে নামাজ আদায় করবেন।
তাই আজান কে এই কাজের উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট করা হয়। যার সবিস্তৃত ঘটনা হাদীসের কিতাবে পাওয়া যায়। আজান ইসলামের এক চিহ্ন বিশেষ যা এই উম্মতের জন্য খাস। পূর্বের উম্মতগণের জন্য আজান ছিল না।
Table of Contents
কতিপয় আজানের ফজিলত :-
১। আজানের আওয়াজ যতদুর পর্যন্ত সুবিস্তৃত হয় এবং জিন ইনসানের মধ্যে যাঁরা উক্ত আওয়াজ শ্রবণ করেন তারা কেয়ামতের দিন আজান দাতার জন্য ঈমানের সাক্ষ্য দেবেন।
২। হুজুর (সঃ) বলেন যদি মানুষ জানতে পারে যে আজান দিলে কত ছওয়াব হয়, তাহলে এই দায়ীত্ব কুরয়া (লটারী) করে ছাড়া পাওয়া যেত না আর মানুষ এর জন্য অবশ্যই কুরয়া আন্দাজী করত। (বুখারী-মুসলিম)
৩। আজান দেওয়ার সময় শয়তানের উপর খুব ভয় ভীতি ছেয়ে যায় এবং জ্ঞানশূন্য হয়ে পালাতে থাকে। যত দূর আজানের আওয়াজ যায় ততদূর সে দাঁড়াতে পারে না। (বুখারী-মুসলিম)
মাসয়ালা :- ওয়াক্ত হওয়ার পূর্বে আজান দিলে আজান সঠিক হবে না। উক্ত আজান পুণরায় দিতে হবে। (মারাকিউল ফালাহ)
মাসয়ালা :- আজান এবং একামত আরবী ভাষায় ঐ শব্দদ্বারা হতে হবে যা হুজুর (সঃ) হতে বর্ণিত আছে। যদি ফারসী অথবা অন্য ভাষায় আজান দেওয়া হয় মানুষ বুঝতে পারলেও সঠিক হবে না। (মারাকিউল ফালাহ)
মাসয়ালা :- আজান দাতা পুরুষ হতে হবে। যদি কোন নারী আজান দেয় ঐ আজান পুণরায় দিতে হবে। তানাহলে যদি নামাজ পড়া হয় ঐ নামাজ বিনা আজানে নামাজের ন্যায় হবে। (মারাকিউল ফালাহ ইত্যাদি) মাসয়ালা :- আজান দাতা বুদ্ধি সম্পন্ন হতে হবে। যদি কোন পাগল বা অবুঝ বাচ্চা আজান দেয় তাহলে আজান সঠিক হবে না। (মারাকিউল ফালাহ ইত্যদি)
আজানের সুন্নাত তরীকা বা নিয়ম
মাসয়ালা :- প্রথম চার বার আল্লাহু আকবার শব্দগুলি দুই বার করে মিলিয়ে বলতে হয়। ঐ সময় “র” হরফটির উপর জবর অর্থাৎ “আকার” পড়া উত্তম।
মাসয়ালা :- حَى عَلَى الصلوة বলার সময় মুখ ডানদিকে এবং حَيَّ عَلَى الْفَلَاحِ বলার সময় বাম দিকে মুখ ফেরাতে হয়। খুব খেয়াল রাখতে হবে যেন মুখ ফিরানোর সময় বুক এবং পা কিবলা দিক হতে সরে না যায়।
মাসয়ালা :- আজান দেওয়ার মাঝে কোন কথা বললে উক্ত আজান পুণরায় দিতে হবে। আওয়াজ পরিস্কার করার জন্য গলা খাঙ্কার দিলে দোষ হবে না।
মাসয়ালা :- ফজরের আজানে হাইয়া আলাসসালাহ এবং হাইয়াআলাল ফালাহের পর اَلصَّلُوةُ خَيْرٌ مِّنَ النَّوْمِ আসসলাতু খাইরুম মিনান্নাউম (ঘুম অপেক্ষা নামাজ উত্তম) দুবার বলতে হয়।
মাসয়ালা :- আজানের জওয়াব দেওয়া ওয়াজিব। মুয়াজ্জিন আজানে হায় আলাস্সালাহ ,হায় আলালফলাহ যখন বলবে তখন উত্তরে ( লাহাওলা ওয়াল কুউঅতা ইল্লা বিল্লাহ) বলতে হয়। আর ফজরের আজানে الصَّلوةُ خَيْرٌ مِّنَ النَّوْمِ এর পরিবর্তে صَدَقْتَ وَبَرَرْتَ (সদাকতা অ বারারতা) বলতে হয়। অর্থাৎ আপনি সত্য বলেছেন এবং আপনি কল্যাণময় হয়েছেন।
আজানের পরের দোওয়ার ফজীলত
হজরত জাবির (রাঃ) হতে বর্ণিত হুজুর (সঃ) বলেন, যে ব্যক্তি আজান শোনার পর নিম্নোক্ত দোয়া পাঠ করেন কেয়ামতের দিন তার জন্য আমার সুপারিশ অবধারিত হয়ে যায়।
اللَّهُمَّ رَبَّ هَذِهِ الدَّعْوَةِ التَّامَّةِ وَالصَّلوةِ الْقَائِمَةِ اتِ مُحَمَّدَ نِ الْوَسِيلَةَ وَ الْفَضِيلَةَ وَابْعَثُهُ مَقَاماً مَّحْمُودَ نِ الَّذِى وَعَدتَّهُ إِنَّكَ لَا تُخْلِفُ الْمِيعَادِ
উচ্চারণ :- আল্লাহুম্মা রব্বা হাজিহিদ দা’ওয়াতিত্তাম্ম্মাতি অসসলাতিল ক্বায়িমাতি আতি মুহাম্মাদানিল অসিলাতা অলফাদিলাতা অবআছহু মাকামাম মাহমূদানিল্লাজি অআত্তাহু ইন্নকা লা তুখলিফুল মীয়াদ।
অর্থঃ হে আল্লাহ! যিনি এই পরিপূর্ণ আহ্বান ও প্রতিষ্ঠ নামাজের প্রভু। আপনি দান করুন হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) কে নৈকট্য (অসিলা) এবং পরিপূর্ণ মর্যাদা এবং তাঁকে ঐ প্রশংসিত স্থান দান করুন যার আপনি অঙ্গিকার করেছেন। অবশ্যই আপনি অঙ্গিকার ভঙ্গ করেন না। (মারাকিউল ফালাহ)
হযরত ইবনে উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত তিনি হুজুর (সঃ) হতে বর্ণনা করেন যে, যখন তোমরা মুয়াজ্জিনের আজান শুনবে তোমরাও অনুরূপ বল যেমন মুয়াজ্জিন বলেন অতঃপর আমার প্রতি দরুদ পাঠ কর কারণ যে ব্যক্তি আমার প্রতি একবার দরুদ পাঠ করেন আল্লাহ তায়ালা তার প্রতি ১০ বার রহমত বর্ষণ করেন। তার পর আল্লাহর কাছে “অসীলা” চাও, কারণ অসীলা হল জান্নাতের একটা মঞ্জিল। যা আল্লাহর মোমিন বান্দাগণের মধ্যে কোন একজনের জন্য হবে। আর আমি আশাকরি আমিই সেই ব্যক্তি হব। অতএব যে ব্যক্তি আমার জন্য অসীলা চাইবে তার জন্য আমার সুপারিশ অবধারিত হয়ে যাবে। (মারাকিউল ফালাহ) রদ্দুল মুহতার ২৬৭, ১-খণ্ড
নামাজ শুরু হওয়ার পূর্বে আজানের শব্দ গুলি একটু কম দীর্ঘ করে তুলনা মূলক তাড়াতাড়ি পড়তে হয় তাকে একামত বা তাকবীর বলে। একামত এবং আজানের শব্দ সবই সমান। কেবল قَدْ قَامَتِ الصَّلحَيَّ “হৃদক্বামাতিসলাত” (নামাজ এখনই প্রতিষ্ঠিত হল) দুবার বলতে হয়।
আজান ও একামাতের কিছু মাসায়েল
মাসয়ালা :- যদি কোন ব্যক্তি আজানের জওয়াব দিতে ভুলে যান, অথবা ইচ্ছাকৃত জওয়াব না দিয়ে থাকেন, তাহলে যদি বেশী দেরী না হয়ে যায় তাহলে জওয়াব দিবেন।
মাসয়ালা :- একামত দেওয়ার পর যদি বেশী সময় অতিবাহিত হয়ে যায় আর জামায়াত যদি না হয়ে থাকে তাহলে পুনরায় একামত দেওয়া উচিৎ।
মাসয়ালা :- যদি মুয়াজ্জিন আজান দেওয়ার সময়ে মুরতাদ হয়ে যান (নউজুবিল্লাহ) অথবা অচৈতন্য হয়ে যান, অথবা তাঁর আওয়াজ বন্ধ হয়ে যায়, অথবা আজান ভুলে যান এবং সেখানে স্মরণ করিয়ে দেওয়ার মত কেউ না থাকে তাহলে উক্ত আজান পুণরায় দেওয়া সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ। (দুরুল মুখতার)
মাসয়ালা :- যদি আজান বা একামত দিতে দিতে কারো ওজু ভেঙ্গে যায় তাহলে আজান একামত পূর্ণ করে তারপর ওজু করবে।
মাসয়ালা :- এক মুয়াজ্জিনের জন্য দুটি মসজিদে আজান দেওয়া মাকরূহ। যে মসজিদে তিনি ফরজ পড়বেন সেই মসজিদে আজান দেবেন। (দুরুল মুখতার)
মাসয়ালা :- যিনি আজান দেবেন একামত দেওয়া ও তাঁরই অধিকার। কিন্তু যদি তিনি কোথায়ও চলে যান অথবা অন্যকে অনুমতি দেন তাহলে অন্য জনও দিতে পারেন।
মাসয়ালা :- যদি কয়েক জন ব্যক্তি একত্রিত হয়ে যুগ্ম কণ্ঠে আজান দেন তাও জায়েজ আছে। (শামী)
মাসয়ালা :- একামত পড়া যে স্থানে শুরু করা হয়েছে সেখানেই শেষ করা উচিৎ। আজান এবং একামতের জন্য নিয়াত শর্ত নয়। তবে হ্যাঁ নিয়াত ছাড়া সওয়াব পাওয়া যায় না তাই এমন নিয়াত করা ভালো যে আমি আজান অথবা একামত কেবল আল্লাহর উদ্দেশ্যে দিচ্ছি অন্য কোন উদ্দেশ্যে নয়।
মাসয়ালা :- আজান এবং একামত পড়া কালে অন্য কোন কথা বলা উচিৎ নয়। যদি অন্য কথা বলা হয় আর তা যদি অধিক হয় তাহলে আজান পুণরায় দিতে হবে কিন্তু একামত পুণরায় দিতে হবে না। (দুরুল মুখতার)
মাসয়ালা :- একামতের জওয়াব দেওয়া মোস্তাহাব। এর জওয়াব আজানের মতই কেবল “কদকমাতিসলাহ” শুনলে তার উত্তরে “আকামাহাল্লাহু অ আদামাহা” বলতে হয়।
মাসয়ালা :- জুময়ার প্রথম আজান শোনার পর সর্বপ্রকার কাজকর্ম ছেড়ে নামাজের জন্য মাসজিদে যাওয়া ওয়াজিব। নামাজ ছাড়া অন্য কোন কাজে লিপ্ত হওয়া হারাম।
মাসয়ালা :- কাজা নামাজ আদায় করার সময়ে আজান ও একামত উভয়ই দিতে হবে। কিন্তু কয়েক ওয়াক্তের নামাজ কাজা হলে প্রথমটার জন্য আজান ও একামত উভয় দিতে হয়। অন্য নামাজ গুলির জন্য কেবল একামত দেওয়াই যথেষ্ট হবে।
মাসয়ালা :- আজান দাঁড়িয়ে দিতে হয়। যদি কেউ বসে দেয় তাহলে তা মাকরূহ হবে।
মাসয়ালা :- আজান বা ইকামতের কোন শব্দ বাদ গেলে যদি সঙ্গে সঙ্গে মনে আসে তাহলে সেখান থেকে পুনরায় আজান দিতে হবে আর যদি আজান শেষ হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর মনে আসে তাহলে পরে পুনরায় আজান দিতে হবে। রদ্দুল মুহতার কিতাবে ১ম খণ্ড, ২৫৯ পৃষ্ঠায় আছে।
– وَيَكْرَهُ تَرْكُهُ وَتَنْصُبُ إِعَادَتُهُ মাকরূহ এবং উক্ত আজান পুনরায় দেওয়া মুস্তাহাব।
মাসয়ালা :- আজান দেওয়া কেবল ফরজ নামাজের জন্য সুন্নাত। অন্য নামাজে যেমন-ঈদের নামাজের জন্য সুন্নাত নয়। وَلَا يَسْنُ لِغَيْرِهَا كَعِيدٍ
মাসয়ালা :- আজানের সময় কানে আঙুল রাখা মুস্তাহাব।
وَيَجْعَلُ نُدُباً إِصْبَعَيْهِ فِي صِمَاحَ أُذْنَيْهِ (در المختار: صنيه)
মাসয়ালা :- আজানের শব্দগুলি ধীরে ধীরে, পৃথক পৃথক ভাবে এতটা দেরী করে বলা সুন্নত যে, সেই সময়ে উত্তর দেওয়া সম্ভব হয়। যদি এর থেকে তাড়াতাড়ি আজান দেওয়া হয় তাহলে পুনরায় আজান দেওয়া মুস্তাহাব।
মাসয়ালা :- একামত দেওয়ার সময় দেরী করার প্রয়োজন নেই বরং তাড়াতাড়ি দেওয়া মুস্তাহাব।
মাসয়ালা :- ফাসিক ব্যক্তির আজান মাকরূহ।
মাসয়ালা :- যদি আজান বা ইকামতের মাঝে বেশী কথা বলে ফেলে তাহলে প্রথম থেকে পুনরায় আজান দিতে হবে।
ولا يَتَكَلَّمُ فِيهِمَا أَصْلاً فَإِنْ يَتَكَلَّمُ اسْتَانَفَهُ ( رد المحتار : صبيح)
মাসয়ালা:- দাড়ী মুণ্ডন করা অথবা দাড়ী ছাঁটা ব্যক্তির আজান মাকরূহ। মাসয়ালা :- আজানের সময় অন্যান্য কথার ন্যায় কুরআন শরীফ তেলাওয়াৎ বন্ধ করা উচিৎ এবং আজানের জওয়াব দেওয়া ওয়াজিব
فَيَقْطَعُ قَرَأةَ الْقُرْآنِ لَوْ كَانَ يَقْرَأُ وَيُجِيبُ (در المختار : ص )
মাসয়ালা :- যদি কেউ মসজিদের সীমানার ভীতরে থাকে তাহলে উক্ত মসজিদে আজান হলে সেখান থেকে চলে যাওয়া মাকরূহ। তবে যদি পুনরায় সেখানে এসে নামাজ পড়ার ইচ্ছা থাকে বা মসজিদের সীমানার বাইরে থাকে তাহলে চলে গেলে মাকরূহ হবে না।
‘মাসয়ালা :- আজানের জওয়াব দেওয়া ওয়াজিব।
মাসয়ালাঃ- যদি ফজরের আজানে اَلصَّلُوةُ خَيْرٌ مِّنَ النَّوْمِ বলতে ভুলে যায় এবং আজানের পর সঙ্গে সঙ্গে মনে আসে তাহলে الصَّلُوةُ خَيْرٌ مِّنَ النَّوْمِ বলে তার পর বাকী শব্দ গুলো পুনরায় বলবে। আর যদি সঙ্গে সঙ্গে না মনে আসে তাহলে পুনরায় আজান দেওয়ার প্রয়োজন নেই কারণ ঐ শব্দ যুক্ত করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ নয় বরং মুস্তাহাব।
মাসয়ালা :- বুদ্ধিমান নাবালিগের জন্য আজান দেওয়া কোনো বাঁধা ছাড়াই জায়েজ।
وَيَجُوزُ بِلا كَرَاهَةٍ أَذَانُ صَبِي مُراهق (رد المحتار : صلي )