পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমান নারী ও পুরুষের উপর ফরজ।নামাজের গুরুত্ব নিয়ে আল্লাহ তায়ালা কুরআন পাকে এরশাদ করেছেন-
فَسُبْحَانَ اللَّهِ حِينَ تُمْسُونَ وَحِينَ تُصْبِحُونَ وَلَهُ الْحَمْدُ فِي السَّمواتِ وَالأَرْضِ وَعَشِيًّا وَحِينَ تُظْهِرُونَ
(সুরা রুম ১৭ ও ১৮ নং আয়াত)
Table of Contents
নামাজ কে আরবীতে ছালাত বলে। এর আভিধানিক অর্থ হল আগুনের উত্তাপে বক্র জিনিস কে সোজা করা, দোওয়া করা ও সম্মান প্রদর্শন করা।
ব্যবহারিক অর্থে নামাজ মানুষের বক্র স্বভাব দূর করে চরিত্র বান করে তোলে এবং নামাজীকে নামাজের আগুনে জালিয়ে তার সমস্ত পাপ পুড়িয়ে খাঁটী সোনার মত বিশুদ্ধ করে দেয়।এটাই নামাজের গুরুত্ব।
অর্থ:– অতএব তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা বর্ণনা কর যখন তোমাদের সন্ধ্যা হয় ও যখন তোমাদের প্রভাত হয় এবং তাঁরই জন্য নভোমণ্ডল ও ভূমণ্ডলের সমস্ত প্রশংসা এবং অপরাহ্নে ও যখন তোমাদের দ্বিপ্রহর অতীত হয়।
একদল উলামা বলেন যে, যখন মক্কা শরীফে এই আয়াত অবতীর্ণ হয়েছিল তখন মুসলমান দিগের উপর পাঁচ বার নামাজ পড়া ফরজ ছিল না। তখন শুধু প্রভাতেও সন্ধ্যায় কয়েকবার “সোবহান আল্লাহ” এবং দ্বিপ্রহরেও অপরাহ্নে কয়েকবার “আলহামদু লিল্লাহ” পাঠ করতে হতো।
কিন্তু হজরত এবনে আব্বাস (রাঃ) হতে বর্ণিত যে, উক্ত আয়াতদ্বয় পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের অন্যতম বিশিষ্ট প্রত্যাদেশ। উক্ত আয়াতদ্বয়ের মধ্যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ইঙ্গিত আছে যেমন “তুমসুন” অর্থাৎ সূর্যাস্তের পরবর্তী মগরেব ও ইশার নামাজ এবং “তুসবিহুন” প্রভাত অর্থাৎ সূর্য উদয়ের পূর্ববর্তী সময় ফজরের নামাজ। “তুজহিরুন” দ্বিপ্রহরাতীত অর্থাৎ মধ্যাহ্নের পরবর্তী সময় জোহরের নামাজ। “আশিয়া” অপরাহ্ন অর্থাৎ বিকাল বেলা আসরের নামাজ।
নামাজের গুরুত্ব দিতে কুরআন শরীফে আল্লাহ তায়ালা বলেন-
وَأَقِمِ الصَّلوةَ طَرَفَيِ النَّهَارِ وَزُلْفَاً مِّنَ الَّيْلِ إِنَّ الْحَسَنَاتِ يُذْهِبْنَ السَّيَاتِ ذَالِكَ ذِكْرَى لِلَّذِينَ
(১২ পারা, সুরা হুদ, আয়ত নং ১১৪)
অর্থঃ– এবং তোমরা দিবসের দুই ভাগে ও রজনীর প্রথমাংশে নামাজ প্রতিষ্ঠা কর। নিশ্চয় সৎকার্য্যাবলী গোনাহ সমূহ কে দূর করে দেয়। স্মরণ কারী দিগের জন্য ইহা সৎ উপদেশ। মুসলমানদিগকে দিন ও রাতের পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তে হয়। এই পবিত্র আয়াতে নামাজের সময় সমূহ নির্দেশ করা হয়েছে।
এখানে দিবসের দুটো ভাগ করা হয়েছে।
১ম ভাগ– দিবসের প্রথম ভাগের নামাজ বলতে “ফজরের” নামাজ বা প্রভাত কালীন প্রার্থনা।
২য় ভাগ– দিবসের দ্বিতীয় ভাগের নামাজ অর্থ “জোহর ও আসর” নামাজ বুঝানো হয়েছে। রজনীর প্রথমাংশের নামাজ বলতে সূর্যাস্তের পরবর্তী সময় “মগরেব ও ইশার” নামাজ সন্ধ্যা ও নৈশ নামাজ বুঝানো হয়েছে।নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে ইমাম আজম আবু হানিফা (রঃ) “বেতের” নামাজ পাঠ করাও এই আয়াত অনুযায়ী “ওয়াজেব” অর্থাৎ অত্যাবশ্যক বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। বিশিষ্ট তফসীর সমূহে এই মতই সর্ব সম্মতিক্রমে সমর্থিত হয়েছে।
এই আয়াতে “হাসানাত” শব্দ দ্বারা নামাজ ও “সাইয়াত” শব্দ দ্বারা পাপের প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।
হজরত ইবনে আব্বাস (রাঃ) এঁর মতে এ স্থলে ” হাসানাত” এর মর্মার্থ পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ। কারণ এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ দ্বারা যাবতীয় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র পাপ দূরীভূত হয়ে থাকে। (তঃ হাক্কানী)
ইসলামের মূল পাঁচটি বুনিয়াদের মধ্যে নামাজ দ্বিতীয় বুনিয়াদ। যেমন-নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে হুজুর পাক (সঃ) হাদিছ শরীফে এরশাদ করেছেন যে-
عَنِ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ بَنِي الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ شهادة أن لا إله إلا الله وَأَنَّ مُحَمَّدًا عَبْدُهُ وَرَاقُ وَرَاقُ وَرَاقُةُ وَرَاقُةُ
ابْنَاهُ الرَّكوةِ وَ الْحَجُّ وَ صَوْمُ رَمَضَانَ (متفق عليه)
অর্থঃ- হজরত ইবনে উমর (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন যে রসুলুল্লাহ (সঃ) বর্ণনা করেছেন ইসলাম কে পাঁচটি স্তম্ভের উপর প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে। (১) সাক্ষ্য প্রদান করা যে, এক আল্লাহ ছাড়া কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও প্রেরিত রসুল (২) নামাজ কায়েম করা (৩) জাকাত আদায় করা (৪) হজ্ব করা (৫) রমজান শরীফের রোজা রাখা।
উক্ত হাদিছে বর্ণিত পাঁচটি জিনিসই ঈমানের প্রধান ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। তবে এর ভিতরে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল ১নং হাদাত প্রদান করা, যেটা কে ঈমান বলা হয়। আর ঈমানের উপর সমস্ত আমলের প্রতিদান দেওয়া হয়।
উক্ত পাঁচটি জিনিসের মধ্যে ঈমানের পরে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ আমল হল নামাজ যথা উক্ত হাদিছ শরীফ দ্বারা প্রমানিত হয়। নামাজের গুরুত্ব আরোপ করে নবী পাক (সঃ) বিভিন্ন জায়গায় এরশাদ করেছেন যে,
وَاعْلَمُوا أَنَّ أَفْضَلَ أَعْمَالِكُمُ الصَّلُوةُ
অর্থ:- জেনে রাখ, নামাজই তোমাদের সর্ব শ্রেষ্ঠ আমল (তবরাণী)
بين الرَّجُلِ وَ بَيْنَ الْكُفْرِ تَرْكُ الصَّلوة
অর্থ:-নামাজের গুরুত্ব আলোচনায়ঃ নবী পাক (সঃ) বলেছেন নামাজ পরিত্যাগই মানুষ এবং কুফরের মধ্যবর্তী নিদর্শন।
অর্থাৎ– নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে আরও বলেন নামাজ পরিত্যাগ করলে মানুষও কুফরের মধ্যে ব্যবধান বাকী থাকে না, বরং সে কুফরের সীমায় পৌঁছে যায়।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ لَأَسَهُمْ فِي الإِسْلَامِ لِمَنْ لَا صَلُوةَ لَهُ
অর্থ :- হজরত আবু হুরায়রা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নবী পাক (সঃ) বলেছেন নামাজ পরিত্যাগকারীর জন্য ইসলাম ধর্মে কোন অধিকার বা অবকাশ নেই। (বজ্জার)
: عنْ أَنَسٌ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللهِ مَنْ تَرَكَ صَلوةٌ مُتَعَمِّداً فَقَدْ كَفَرَ جَهَاراً
হজরত আনাস (রাঃ) বর্ণনা করেছেন যে, নবী পাক (সঃ) বলেন, যে স্বেচ্ছায় স্বজ্ঞানে নামাজ পরিত্যাগ করল, সে প্রকাশ্যে কুফরী করল। (তবরাণী)
নামাজের গুরুত্ব:- যে ব্যক্তি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ কে ফরজ বলে স্বীকার করে না, সে প্রকৃত পক্ষে কাফের, ইসলামের মধ্যে তার কোন স্থান নেই আর কাফেরদের জন্য অনন্তকাল জাহান্নামের শাস্তি নির্দ্ধারিত।
পক্ষান্তরে যে নামাজ কে ফরজ বলে স্বীকার করে কিন্তু তা বিনা ওজরে পরিত্যাগ করে তবে সে কাফের নয়, কিন্তু ইসলামের সীমা বহির্ভূত, এমন ব্যক্তি ইসলামের শেষ সীমায় কুফরের চরম নিকটে উপস্থিত, তার এবং কুফরের সীমানার মধ্যে ব্যবধান নেই। ফলে সব সময়ই সর্ব্বনাশের ঘোরতর আশঙ্কা।
নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে ইমাম আবু হানিফা (রঃ) এঁর মতে এটাই হল উল্লিখিত হাদিছ গুলির ভাবার্থ তবে ইমাম আহমাদ (রঃ) প্রমুখ মহা পণ্ডিত ও মুহাদ্দিছগণ নামাজ পরিত্যাগকারীকে কাফের বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন, বিখ্যাত ইমাম শাফেয়ী (রঃ) নামাজ পরিত্যাগকারীকে তওবা না করলে হত্যা করার বিধান দিয়েছেন।
নামাজের গুরুত্ব সম্পর্কে নবী পাক (সঃ) এঁর আরো বহু হাদিছ পাক আছে। স্বয়ং আল্লাহ পাক পবিত্র কুরআন পাকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে কম বেশী ৮২ জায়গায় নামাজের নির্দেশ নামা দিয়েছেন।
তাসত্ত্বেও মুসলিম সমাজের এমনও অনেক মানুষ আছেন যারা অবহেলা বশতঃ ইচ্ছাকৃত ভাবে নামাজের গুরুত্ব দেন না বা নামাজ পরিত্যাগ করে থাকেন। আল্লাহ পাক আমাদের সকল কে নামাজের গুরুত্ব বুঝবার ও নামাজের যথাযথ ইতমিনানের সাথে নামাজ কায়েম করবার তাওফীক দান করুন। আমীন ছুম্মা আমীন।
হুজুর পাক (সঃ) মি’রাজ শরীফের মাধ্যমে মানব সম্প্রদায়ের জন্য দিন রাত পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের ফরজিয়াত হুকুম প্রাপ্ত হয়েছিলেন। এই পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করা প্রত্যেক মুসলমান নর-নারীর উপর ফরজ। পবিত্র হাদিস শরীফের বর্ণনা অনুযায়ী-নামাজ মুমিনদের জন্য মি’রাজ স্বরূপ, ইসলামের মূল পাঁচটি স্তম্ভের মধ্যে নামাজ দ্বিতীয় স্তম্ভ। হুজুর পাক (সঃ) হাদিস শরীফে এরশাদ করেন।
عَنْ ابْنِ عُمَرَ قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ بَنِي الْإِسْلَامُ عَلَى خَمْسٍ شَهَادَةُ أَنْ لَا إِلَهَ إِلَّا اللَّهُ رَأَنَ وَإِلَّا اللَّهُ وَأَنَهُ وَإِلَّا اللَّهُ وَأَنَ مَحُدُهُ ِقَامُ الصَّلوةِ وَ
ايتاء الزكوة و الحج وصوم رمضان ( متفق عليه )
অর্থঃ- হজরত ইবনে উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন যে, রসুলুল্লাহ (সঃ) বর্ণনা করেছেন, ইসলামকে পাঁচটি স্তম্ভের উপর দাঁড় করানো হয়েছে।
(ক) সাক্ষ্য প্রদান করা যে, এক আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কোন মাবুদ বা উপাস্য নেই এবং হজরত মুহাম্মাদ (সঃ) তাঁর বান্দা ও তাঁর প্রেরিত রসুল
(খ) নামাজ কায়েম করা
(গ) জাকাত আদায় করা
(ঘ) হজ্ব করা
(৫) রমজান শরীফের রোজা রাখা।
নামাজের ফজিলাত:ফজিলাত ও মহত্ত্ব বর্ণনা
পূর্বে বর্ণিত পাঁচটি স্তম্ভ মুসলমানদের অবশ্য পালনীয়। তবে এর ভিতরে সব থেকে গুরত্ব পূর্ণ বিষয় হল নামাজ। হজরত আব্দুল্লাহ বিন মাসউদ (রাঃ) বলেন, আমি রসুলে পাক (সঃ) কে জিজ্ঞাসা করলাম আল্লাহ তায়ালার নিকট কোন আমল সব থেকে বেশি প্রিয়? হুজুর পাক (সঃ) বললেন নামাজ।
মোল্লা আলী ক্বারী (রঃ) বলেন, এই হাদিস শরীফ দ্বারা প্রমানিত হয় যে, ইমানের পর সব থেকে গুরুত্ব পূর্ণ বিষয় হল নামাজ। অন্য একটি হাদিসে বর্ণিত আছে, الصلوة خَيْرُ موضوع আল্লাহ তায়ালার মনোনীত সর্বোত্তম আমল হল নামাজ।
নামাজের ফজিলতঃ-ক্বিয়ামত বা মহা বিচারের ময়দানে আল্লাহ পাক সর্বপ্রথম বান্দার নামাজের হিসাব চাইবেন। যারা সঠিক ভাবে নামাজ আদায় করে, তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালার প্রিয় রসুল হজরত মুহাঃ (সঃ) তাঁর সোনার জবান মুবারক দিয়ে হাদিস শরীফের ভিতরে অনেক ফজিলাত ও মহত্ত্ব বর্ণনা করেছেন।
عَنْ أَبِي ذَرِّ أَنَّ النَّبِيَّ ﷺ خَرَجَ فِي الشَّتَاءِ وَالْوَرَقَ يَتَهَافَتْ فَأَخَذَ مِنَ شَجَرَةٍ قَالَ فَجَعَلَ ذالِكَ الْوَرَقَ يَتَهَافَتْ فَقَالَ يَا أَبَا ذَرِّ قُلْتُ لَيْكَ يَا رَسُولَ اللَّهِ قَالَ إِنَّ الْعَبْدَ الْمُسْلِمَ لَيُصَلَّى الصَّلوةَ يُرِيدُ بِهَا وَجْهَ اللَّهِ فتهافَتْ عَنْهُ ذُنُوبُهُ كَمَا تَهَافَتَ هذا الْوَرَقَ عَنْ هَذِهِ الشَّجَرَةِ (احمد )
অর্থঃ- হজরত আবুজর (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক সময়ে শীতকালে নবী করীম (সঃ) বাইরে তশরীফ নিয়ে গেলেন। সে সময়ে গাছ থেকে পাতা ঝরছিল। অতঃপর রসুলুল্লাহ গাছটির একটা ডাল হাত দিয়ে ধরলেন। ফলে তা থেকে পাতা আরো বেশি পরিমান ঝরতে লাগল।
নামাজের গুরুত্ব দিতে হুজুর (সঃ) বললেন, হে আবুজর! আমি বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ আমি উপস্থিত। তখন হুজুর (সঃ) এরশাদ করলেন, কোন মুসলমান যখন আল্লাহ তায়ালার রেজামন্দির জন্য নামাজ আদায় করে, তখন তার গোনাহ সমূহ এই গাছের পাতার মত ঝরে যায়। (আহমদ)
জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ- শীত কালে বৃক্ষের পাতা খুব বেশি পরিমান ঝরে। কোন কোন গাছে একটা পাতাও বাকী থাকেনা। ঠিক সেরকম বান্দা লিল্লাহিয়তে এখলাসের সাথে নামাজ আদায় করলে সব গোনাহ মাফ হয়ে যায়। কিন্তু তার কবীরা গোনাহগুলো থেকে যায়। কারণ কবীরা গোনাহ তওবা ছাড়া মাফ হয়না। সে কারণে নামাজের সাথে সাথে তওবা এস্তেগফারের দিকে মনোযোগী হওয়া দরকার।
অবশ্য আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছা করলে স্বীয় মেহের বানীতে কারোর সকল প্রকার গোনাহ মাফ করতে পারেন। এটা ভিন্ন কথা। মসনদে আহমদে আছে, সুবিখ্যাত সাহাবী হজরত সালমান ফারসী (রাঃ) বলেন একদা আমি হজরত নবী করীম (সঃ) এঁর সঙ্গে একটি গাছ তলায় উপস্থিত হলাম, তিনি ঐ গাছের একটি শুকনো ডাল নাড়া দেন, ফলে ঐ শাখা হতে পাতা গুলি ঝর ঝর করে পড়তে থাকে, আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে তিনি বললেন সালমান! কেন আমি এমন করলাম, আমাকে জিজ্ঞাসা করলে না কেন? আমি যখন জিজ্ঞাসা করলাম তখন হুজুর (সঃ) বলেন-
إِنَّ الْمُسْلِمَ إِذَا تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوَضُوءَ ثُمَّ صَلَّى الصَّلَوَاتِ الخَمْسَ
تَحَاتَتْ خَطَايَاهُ كَمَا تَحَاتَ هَذَا الْوَرَقُ
অর্থাৎঃ-মুসলমান যখন সুন্দর রূপে ওজু করে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে তখন ঐ পাতাগুলির ন্যায় তার দেহ হতে সকল পাপ ঝরে পড়ে।
দেহের সঙ্গে মনের নিবীড় সম্পর্ক। দৈহিক পরিছন্নতা লাভ না হলে মন নির্মল হয় না। আর ঐ মন নিয়ে নামাজে মশগুল হলে আল্লাহর প্রেম ও ভালবাসা লাভ হয় না। তাই নামাজের প্রস্তুতির পূর্বে প্রথমে দৈহিক পরিচ্ছন্নতা অর্জন করা আবশ্যক। অর্থাৎ উত্তম রূপে ওজু করা। ওজু মানব দেহে টনিকের কাজ করে।
ভাল ভাবে ওজু করলে শরীর হালকা বোধ হয় ও মনে মনে ফুর্ত্তি ও উদ্যম সৃষ্টি হয়, দেহ মন সজীব ও চাঙ্গা হয়ে ওঠে, প্রত্যেক নামাজের সময় সুষ্ট ভাবে ওজু করা, কঠিন কাজও তাদের কাছে সহজ সাধ্য হয়, তাই সে নামাজে গোনাহ ঝরে যায়।
সে নামাজের জন্য প্রথমতঃ উত্তমরূপে ওজু দরকার। দ্বিতীয়তঃ মনোনিবেশ একাগ্রচিত্তে নামাজ। নামকে ওয়াস্তে নামাজী লোক দেখানো নামাজী নয়, যে নামাজের মধ্যে ভক্ত প্রেমিক প্রিয়তম আল্লাহ তায়ালার প্রেমে তন্ময় হয় এবং সান্নিধ্য উপভোগ করে। যেমন চতুর্থ খলিফা হজরত আলি (রাঃ) আল্লাহর প্রেমে একেবারে বিভোর হয়ে যেতেন, অনেক সময় দেখা গেছে যে, তাঁর বাহ্যিক জ্ঞান পর্যন্ত নেই।
একবার যুদ্ধে তার পায়ে একটা তীর বিদ্ধ হয়ে ছিল, তিনি যন্ত্রনায় ছটফট করছিলেন, কেউ তীরটা টেনে বার করতে গেলে তিনি সহ্য করতে পারছিলেন না, রসুলুল্লাহ (সঃ) কয়েকজন কে ডেকে বললেন, ও ভাবে তীরটা বার করার চেষ্টা করো না, আলী যখন নামাজে দাঁড়াবে তখন কেউ গিয়ে ওটা টেনে বার করে নিও, তাই হল।
হজরত আলী (রাঃ) নামাজে গভীর ভাবে মগ্ন, তাঁর পা থেকে তীরটা টেনে বার করে নেওয়া হল। নামাজ শেষ হয়ে যেতে হজরত আলী (রাঃ) মহাখুশী, তাঁর পায়ে তীর নেই। তখন তাঁকে আসল ঘটনাটা জানান হল। এই হল আল্লাহ ওয়ালা প্রেমিকের নামাজ। তিনি নামাজে এতই বিভোর ও তন্ময় ছিলেন যে, এহেন কষ্টের যন্ত্রনার বিন্দু বিসর্গ টের পাননি।
আমরা কজন নামাজে এমন গভীর তলদেশে তলিয়ে যাই যে, নামাজের দ্বারা গাছের পাতার মত গোনাহ ঝরে যায়? আল্লাহ তায়ালা এমন নামাজী আমাদের কে বানিয়ে দিন, আমীন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةً قَالَ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ ﷺ يَقُولُ أَرَأَيْتُمْ لَوْ أَنَّ نَهْراً بِبَابِ أَحَدِكُمْ بِبَابِ أَحَدِكُمْ يَلْ خَيْمِ فَيْسِيْ فَيْسِي رَّاتٍ هَلْ بَقِيَ مِنْ دَرَتِهِ شَيْيْ قَالُوا لَا يَبْقَى مِنْ دَرَنِهِ شَيْيٌّ قَالَ فَكَذَالِكَ مَثَلُ الصَّلَوَاتِ الْمْسْمْ مَثَلُ
اللَّهُ بِهِنَّ الْخَطَايَا। (بخاري ومسلم)
অর্থঃ- হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি রসুলুল্লাহ (সঃ) কে এরশাদ করতে শুনেছি, তোমরা কি মনে করো, তোমাদের মধ্যে কারোর বাড়ীর সামনে যদি নহর থাকে, আর সে যদি দিনে পাঁচ বার ঐ নহরে গোসল করে, তাহলে তার শরীরে কি ময়লা থাকতে পারে? তাঁরা (সাহাবারা) উত্তর দিলেন, না ইয়া রাসুল্লাহ। তিনি বললেন, দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ও এই রকম। আল্লাহ তায়ালা এর মাধ্যমে নামাজীর যাবতীয় গোনাহ ক্ষমা করে দেন।
জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ- মানুষের গোনাহ বা পাপ মোচনে নামাজ এক গুরুত্ব পূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এক নামাজ থেকে পরবর্তী নামাজ পর্যন্ত বান্দা যে সমস্ত গোনাহের কাজ করে, পরবর্তী নামাজ তার জন্য কাফ্ফারা স্বরূপ হয়ে তার সেই মধ্যবর্তী সময়ের সগিরা গোনাহ গুলো মাফ করে দেয়। এই রূপ দিনে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়লে নামাজীর আর কোন সগিরা গোনাহ বাকী থাকেনা।
মহান দয়ালু আল্লাহ তায়ালা অসীম দয়ালু। তাঁর রহমতের অন্ত নেই। তাঁর রহমত বান্দার গোনাহ মাফ করার জন্য বাহানা তালাশ করতে থাকে। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে। কোন ব্যক্তি তাহাজ্জুদের নিয়ত করে শুয়ে পড়ে, নিদ্রা ভঙ্গ না হওয়ার কারণে তাহাজ্জুদ না পড়তে পারলেও তিনি তাহাজ্জুদ পড়ার ছওয়াব পাবেন। তাঁর এহেন দয়াকে অবহেলা করে বঞ্চিত থাকা- বান্দার জন্য চরম দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছু নয়।
عَنْ حُذَيْفَةً قَالَ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ إِذا حَرَبَهُ أَمْرٌ فَرَعَ إِلَى الصَّلوة (ابوداود)
অর্থঃ- হজরত হোজাইফা (রাঃ) থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সঃ) যখন কোন কঠিন সমস্যায় পড়তেন, তখন সাথে সাথে নামাজের দিকে ধাবিত হতেন। (আবু দাউদ)
জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ-
وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَ الصَّلوة
অর্থঃ- তোমরা নামাজ ও সবরের দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা কর। (১ম পারা, সুরা বাকারা, ৪৫ আয়াত)
নামাজ আল্লাহ তায়ালার একটা বড় রহমত। কোন সমস্যায় নামাজের দিকে ধাবিত হওয়ার অর্থ আল্লাহ তায়ালার রহমতের প্রতি ঝুকে পড়া এবং তা থেকে পরিত্রানের জন্য আল্লাহ তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা করা। আর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা করা। আর স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা সাহায্য কারী হলে, কোন মুসিবত থাকতে পারেনা।
উজ্জ্বল দৃষ্টান্তঃ- সাহাবায়ে কেরামদের (রাঃ) ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, তাঁরাও হুজুর পাক (সঃ) এঁর মত মসিবতের সময় নামাজে দাঁড়িয়ে যেতেন। এ প্রসঙ্গে হজরত ইবনে আব্বাসের (রাঃ) একটা ঘটনা উল্লেখযোগ্য। তিনি কোন এক সময় এক পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। হঠাৎ তাঁর ভাই কাসেমের মৃ-ত্যু সংবাদ তার কাছে পৌঁছালো। তিনি সাথে সাথে উট থেকে অবতরণ করে রাস্তার পাশে গিয়ে দুই রাকাত নামাজ আদায় করলেন এবং তাশাহুদের মধ্যে দীর্ঘক্ষণ দোওয়া পড়তে থাকলেন। অতঃপর নামাজ শেষ করে উটের পিঠে আরোহন করে কুরআন পাকের এই আয়াত শরীফ
তেলাওয়াত করলেন। وَاسْتَعِينُوا بالصبر والصلوة যার অর্থ তোমরা সবর ও নামাজের দ্বারা আল্লাহ তায়ালার সাহায্য প্রার্থনা কর”।
হজরত উম্মে কুলসুম (রাঃ) এর স্বামী হজরত আঃ রহমান (রাঃ)
অসুস্থ ছিলেন। একবার তিনি এমন অচৈতন্য হলেন যে, সকলে তাকে মৃত বলে ঘোষণা করল। তখন হজরত উম্মে কুলসুম তাড়াতাড়ি নামাজে দাঁড়ালেন। তাঁর নামাজ শেষ হওয়া মাত্র তাঁর স্বামী হজরত আব্দুর রহমান (রাঃ) বর্ণনা করলেন যে, দুজন ফেরেশতা আমার নিকট এসে আমাকে বলল, চল আল্লাহ তায়ালার দরবারে তোমার ফয়সালা হবে। এর পর তারা আমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য উদ্যত হল।
ইতিমধ্যে তৃতীয় একজন ফেরেশতা এসে তাদের কে বাধা প্রদান করে তাদের কে চলে যেতে বলল এবং বলল, ইনি এমন একজন ব্যক্তি যিনি মাতৃগর্ভে সৌভাগ্যবান বলে সাব্যস্ত হয়েছেন। এই ঘটনার পর তিনি আরও একমাস জীবিত ছিলেন।
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةً قَالَ كَانَ رَجُلانِ مِنْ بَنِي حَيٍّ مِنْ قُضَاعَةَ أَسْلَمَا مَعَ رَسُولِ اللَّهِ ﷺ فَاسْتُشْهِ سَرَأُمَاُدَهُمْ أَخْدَهُ نَةً قَالَ طَلْحَةُ بْنُ عُبَيْدِ اللَّهِ فَرَكَيْتُ المُوَخَّرَ مِنْهُمَا أُدْخِلَ الْجَنَّةَ قَبْلَ فَبْلَ فَحَبَكُتَذْكُتْبَذَّهِيدِ فَتَعَلَ فَحَبَكُتَذْكُذْبِيْدِ أَرْتُ ذَالِكَ لِلنَّبِيِّ ﷺ أَوْ ذُكِرَ لِرَسُولِ اللَّهِ ﷺ فَقَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ أَلَيْسَ قَدْ صَامَ بَعْدَهُ رَمَضَانَ وَصَلَّى سِنَّةَ الْآفِ رَكْعَةٍ وَكَذَا وَكَذَا رَكْعَةً صَلوةَ سَنَةٍ – (احمد)
অর্থঃ- হজরত আবু হুরাইরা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, কোন এক গোত্রের দুই ব্যক্তি হুজুর (সঃ) এর কাছে ইসলাম গ্রহণ করেন। অতঃপর তাদের মধ্যে একজন শাহাদাত বরণ করেন এবং দ্বিতীয় জন এক বছর পরে এন্তেকাল করেন। হজরত তালহা বিন উবাইদিল্লাহ (রাঃ) বলেন, আমি স্বপ্নে দেখেছি যে, দ্বিতীয় ব্যক্তিকে শাহাদাত বরণ কারীর পূর্বে বেহেস্তে প্রবেশ করানো হয়েছে।
সুতরাং আমি আশ্চর্য হয়ে গেলাম এবং সকাল বেলা হুজুর পাক (সঃ) এর নিকট এই ঘটনা বর্ণনা করলাম অথবা হুজুর (সঃ) কে এই ঘটনা বর্ণনা করা হল। উত্তরে হুজুর (সঃ) বললেন, দ্বিতীয় ব্যক্তি কি এক মাস রোজা বেশি রাখিনি এবং ছয় হাজারের ও অধিক রাকাত নামাজ বেশি পড়িনি? এভাবেই তার আমল বেড়ে গেল।
জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ– এবনে মাজা শরীফে হজরত তালহা (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, তিনি নিজেই এই স্বপ্ন দেখেন। আবু দাউদ শরীফে অন্য দুই জন সাহাবীর কথা বলা হয়েছে। যাদের মৃত্যুর ব্যবধান ছিল মাত্র আট দিন। এখানেও যিনি পরে এন্তেকাল করেছিলেন, তিনি প্রথমে জান্নাতে প্রবেশ করেছিলেন।
অন্য একটি হাদিসে আছে, দুই ভাই ৪০ দিনের ব্যবধানে এন্তে কাল করেন। যিনি প্রথমে এন্তেকাল করেন, সাহাবাগণ তাকে প্রাধান এন্তে লাগলেন।
প্রকৃতপক্ষে আমরা কল্পনাও করতে পারিনা যে, নামাজ কত বড় দৌলত। হুজুর পাক (সঃ) যাকে আপন চক্ষুর শীতলতা ও তৃপ্তিদায়ক বলে আখ্যায়িত করেছেন, সেটা সাধারণ বস্তু হতে পারেনা বরং সেটা পরম ভালো বাসার বস্তু ছাড়া কিছুই হতে পারেনা।
عَنْ أَبِي قَتَادَةَ بنِ رِبَعِي قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ ﷺ قَالَ اللَّهُ تَبَارَكَ وَتَعَالَى إِنِّي افْتَرَضْتُ عَلَى أُمَّتِكَ خَمْسَ صَلَوَاتٍ وَ عَهِدَتُ عِنْدِي عَهْدًا أَنَّهُ مَنْ حَافَظَ عَلَيْهِنَّ لِوَقْتِهِنَّ أَدْخَلْتُهُ الْجَنَّةَ فِي عَهْدِى وَمَنْ لَمْ يُحَافِظُ عَلَيْهِنَّ فَلَا عَهْدَ لَهُ عِنْدِی (در منثور)
অর্থঃ- হজরত কাতাদাহ বিন রিবয়ী (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন, আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, তোমার উম্মতের উপর আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ করেছি। যে ব্যক্তি গুরুত্ব সহকারে সময়মত আদায় করবে, আমি তার জান্নাতে প্রবেশ করানোর ব্যাপারে প্রতিজ্ঞা বদ্ধ আর যে ব্যক্তি এর প্রতি যত্নবান হবেনা, তার ব্যাপারে আমার কোন দায়িত্ব নেই।
জ্ঞাতব্য বিষয়ঃ- অন্য হাদিসে পরিস্কার ভাবে উল্লেখিত হাদিসের কথা গুলো বর্ণিত হয়েছে। নামাজের কত বড় ফজিলত যে, যারা নামাজের প্রতি যত্নবান হবে, স্বয়ং রাহমানুর রহিম আল্লাহ তায়ালা তাদের দায়িত্ব গ্রহন করে থাকেন এবং নিজ দায়িত্বে তাদের কে জান্নাতে প্রবেশ করিয়ে থাকেন।
আমরা পার্থিব জগতে লক্ষ্য করে থাকি, কোন প্রভাবশালী ব্যক্তি কারো দায়িত্ব ভার গ্রহণ করলে তার আনন্দের আর সীমা থাকেনা বরং সে প্রভাব শালী ব্যক্তির কৃতজ্ঞতা পাশে আবদ্ধ হয়ে যায়। আর এখানে নামাজের মত ভার গ্রহন করেছেন এবং তাকে পুরস্কৃত করেছেন। তবুও আমরা এমন একটা সহজ সাধ্য এবাদতের উপর ভিত্তি করে মহাপ্রভূ স্বীয় বান্দার দায়িত্ব হতভাগা যে, নামাজের ব্যাপারে চরম উদাসীনতার পরিচয় দিয়ে থাকি।