জানাজা নামাজ– মাইয়্যেত কে সম্মুখে রেখে কিবলা মুখি হয়ে চার তাকবীরের সহিত বিনা রুকু সাজদায় যে নামাজ আদায় করা হয় তাকে জানাজার নামাজ বলা হয়। এই নামাজ ফরজে কিফায়া। কিছু সংখ্যক মুসলমান আদায় করে নিলে সকলের দায়িত্ব মুক্ত হয়ে যায়।
মাইয়্যেতের গোসল :-
জানাজা নামাজ এর ন্যায় গোসল দেওয়াও ফরজে কেফায়া যদি লাশ কবরে রাখার পর মাটি দেওয়ার পূর্বে গোসল না দেওয়ার কথা মনে পড়ে তাহলে লাশ বার করে গোসল দিতে হবে।
কাফন পরানোর পর কোন অঙ্গ না ধোওয়ার কথা মনে পড়লে বার করে ধুতে হবে। তবে কোন আঙুল বা আঙুল পরিমান অঙ্গ শুকনো থাকার কথা মনে পড়লে কাফন খুলে ধুতে হবে না। (বাহরুর রাইক, পৃঃ ১৭৩,২য় খণ্ড)
যদি কোন মুরতাদ ব্যক্তি মারা যায় তাহলে তাকে গোসল দিতে হবে না।
যদি মুর্দার চোখ খোলা থাকে তাহলে চোখ দুটি বন্ধ করে দিতে হবে। বন্ধ করার সময় নিম্নের দোয়া পাঠ করতে হয়।
بِسْمِ اللَّهِ وَعَلَى مِلَّةِ رَسُولِ اللَّهِ اللَّهُمَ يَسْرُ عَلَيْهِ أَمْرَةً وَسَهْلُ عَلَيْهِ مَا بَعْدَهُ وَأَسْعِدُهُ بِلِقَائِكَ وَاجْعَلُ مَا خَرَجَ إِلَيْهِ خَيْراً مِّمَّا خَرَجَ عَنهُ ( رد المحتار : ص)
তার পর শরীরের অঙ্গ প্রতঙ্গ সোজা করে দিতে হবে।
কোন মৃতা নারীকে তার স্বামী গোসল দিতে পারবে না বা তাকে স্পর্শ করতে পারবে না তবে তার দিকে দেখতে পারে।
যদি কোন মৃত ব্যক্তি কে পানিতে পাওয়া যায় তাহলে তাকে তুলে গোসল দিতে হবে।
لَوْ وُجِدَ مَيْتٌ فِي الْمَاءِ فَلَا بُدَّ مِنْ غُسْلِهِ ثَلاثاً ( رد المحتار : ص )
মাইয়্যেতকে গোসল দেবার সংক্ষিপ্ত নিয়ম:-
প্রথমে মাইয়্যেতকে ওজু করাবে, কিন্তু কুলি করাবে না বা নাকে পানি দেবে না। কেউ কেউ বলেছেন আঙ্গুলে কাপড় জড়িয়ে দাঁত, দাঁতের উপরের মাংস, পেটের নীচের মাংস গুলো মুছে দেবে এবং কাপড় নাকের মধ্যে প্রবেশ করিয়ে মুছে দেবে। ওজুতে ১ম চেহারা তার পর দুই হাত ধোওয়াবে তার পর মাথা মাসাহ করাবে তার পর দুই পা ধোওয়াবে।
কুলের পাতার অভাবে পরিস্কার পানি দিয়ে মাইয়্যেত কে গোসল দিবে। ১ম মাথা ও দাড়ী সাবান দিয়ে ধোওয়াবে পরে তক্তার উপর বাম কাত করে শোওয়াবে। ডান দিকে তিন বার ধোওয়াবে তার পর মাইয়্যেতকে কিছুতে ঠেস দিয়ে আস্তে আস্তে পেটে মালিশ করবে।
যা কিছু বার হয় সে গুলো ধুয়ে ফেলবে। তার পর মাইয়্যেত কে ডানকাত করে শোওয়াবে এবং বাম দিকে তিন বার ধোওয়াবে তার পর একটা পরিস্কার কাপড় দিয়ে সমস্ত শরীর মুছে দিবে। মাথা ও দাড়ীতে আতর লাগাবে এবং সাজদার জায়গাগুলিতে কপুর লাগাবে। (নামাজ শিক্ষা পৃষ্টা ১৪৪-৪৫ আঃ রুঃ আঃ)
কাফনের মাসায়েল সুন্নাত কাফন :-
পুরুষদের জন্য তিন কাপড় সুন্নাত (১) ইজার (২) পীরহান (৩)। লেফাফা অর্থাৎ মাথা থেকে পা পর্যন্ত ঢাকা চাদর।
নারীদের জন্য পাঁচটি কাপড়ে কাফন দেওয়া সুন্নাত। (১) ইজার (২) পীরহান (৩) লেফাফা (৪) সিনাবন্দ অর্থাৎ বুক থেকে নাভি পর্যন্ত তবে উরু পর্যন্ত হওয়া উত্তম। (৫) উড়নী (তিন হাত লম্বা মস্তক আবরণ)।
কাফন পরাবার নিয়ম:-
পুরুষের জন্য প্রথমে লেফাফা বিছিয়ে তার উপর ইজার বিছাতে হবে। তার পর মুর্দাকে কর্মীস পরিয়ে তার উপর শুইয়ে দিয়ে বাম দিক থেকে প্রথম ইজারের বাম দিক তার পর ডান দিক তার পর লেফাফার বাম দিক তার পর লেফাফার ডান দিক মুড়তে হবে।
যদি কাফন উড়ে বিক্ষিপ্ত হওয়ার সম্ভবনা থাকে তাহলে কাফন দেওয়ার পর বেঁধে দিতে হবে। আর মাইয়্যেত যদি স্ত্রী লোক হয় তাহলে প্রথমে সিনা বন্দ দিয়ে বুক পেট ঢেকে দিতে হবে তার পর চুল গুলো দুভাগ করে দুই কাধ দিয়ে বুকের উপর দিয়ে উড়নী পরাতে হবে। তার পর কর্মীস পরিয়ে ইজার লেফাফা পরাতে হবে।
কোন অসুবিধার কারণে যদি কাপড় না থাকে তাহলে নারীর জন্য তিনটি কাপড় যথেষ্ট। ইজার লেফাফা এবং উড়নী আর পুরুষের জন্য ২টি কাপড় যথেষ্ট ইজার এবং লেফাফা।
কাফনে জরুরত:- যদি কাফনে কেফায়া অর্থাৎ যথেষ্ট পরিমান কাফন না পাওয়া যায় তাহলে যা পাওয়া যাবে তাতে কাফন দিতে হবে। একে কাফনে জরুরত বলে। (দুরুল মুখতার, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৭৯)
বাচ্চা যদি বালেগ হওয়ার কাছাকাছি হয় তাহলে পুরুষ হলে বালেগ পুরুষের মত, আর নারী হলে বালেগা নারীর মত কাফন দিতে হবে।
বাচ্চা যদি বালেগ হওয়ার কাছাকাছিও না হয় তাহলে বালেগ ও বালেগাদের মত দেওয়া অতিউত্তম আর দুটি কাপড় অর্থাৎ ইজার ও লেফাফা দেওয়া উত্তম আর একটা কাপড়ে কাফন দিলেও চলবে। (রদ্দুল মুহতার, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৮০)
যার কোন ধন সম্পদ নেই এমন ব্যক্তি মারা গেলে তার কাফন ঐ ব্যক্তি বহন করবে জীবিত অবস্থায় যে তার দায় ভার বহন করত। স্ত্রীর কাফনের ব্যবস্থা স্বামীর উপর করা ওয়াজিব। (রদ্দুল মুহতার, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৮০)
মৃত সন্তান ভুমিষ্ট হলে তাকে গোসল দিয়ে একটা কাপড়ে আবৃত করে বিনা জানাজায় দাফন করবে। গর্ভস্রাব হলে যদি সন্তানের কোন অঙ্গ পূর্ণ হয়ে থাকে তবে উপরোক্ত নিয়ম পালন করবে। যদি তার কোন অঙ্গ পূর্ণ না হয়ে থাকে তাহলে ঐ মাংস পিণ্ডকে গোসল দেবে না তবে কোন রেওয়াতে গোসল দেওয়ার কথাও আছে। (নামাজ শিক্ষা ১৪৭ আঃ রুঃ আমীন)
জানাজা নামাজ ও দাফনের মাসায়েল
জানাজা নামাজ সহীহ হওয়ার শর্ত নয়টি :-
১। মাইয়্যেত মুসলমান হওয়া
২। মাইয়্যেত ও ইমামের শরীর পাক হওয়া
৩। উভয়ের কাপড় পাক হওয়া।
৪। মাইয়্যেত ইমামের সম্মুখে থাকা
৫। উভয়ের সতর ঢাকা
৬। ইমামের বালেগ হওয়া
৭। মৃত ব্যক্তির রাখার স্থান এবং ইমামের দাঁড়ানোর স্থান পাক হওয়া।
৮। জানাজা পাঠকারীর কেবলার দিকে মুখ করা।
৯। জানাজা পাঠকারীর জানাজা নামাজের নিয়াত করা।
জানাজা নামাজ এর বৈশিষ্ট ২টি :-
১। জানাজা নামাজে চার তকবীর ২।জানাজা নামাজে কেয়াম অর্থাৎ দাঁড়ানো।
জানাজা নামাজের সুন্নাত তিনটি:-
১। ছানা পড়া ২। কোন একটি দরুদ পড়া ৩। কোন একটি দোওয়া পড়া।
মাইয়্যেত যদি অমুসলিম হয় তাহলে জানাজা দুরুস্ত হবে না।
মাইয়্যেত যদি অদৃশ্য হয় গায়েবানা জানাজা দুরুস্ত নয়।
মাইয়্যেত কে গোসল না দেওয়া হলে বা পাক না করা হলে জানাজা দুরুস্ত হবে না।
মাইয়্যেতের সতর ঢাকা জরুরী। মাইয়্যেত উলঙ্গ হলে জানাজা দুরুস্ত হবে না।
যদি জীবিত মানুষ কে কাফন পরিয়ে জানাজা পড়া হয় তাহলে দুরুস্ত হবে না।
দেশদ্রোহী বা রাহজানী কারী মাইয়েত কে গোসল দেওয়া হবে না এবং জানাজাও পড়া হবে না। (দুরে মুখতার, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৮৩)
জানাজা নামাজ হয়ে যাওয়ার পর যদি কিছু লোক একত্রিত হয় তাহলে পুনরায় জানাজা জায়েজ নয়।
আত্মহত্যা কারীকে গোসল দিতে হবে এবং জানাজাও পড়তে হবে (দুরুল মুখতার)।
مَنْ قَتَلَ نَفْسَهُ وَلَوْ عَمَداً يُغْسَلُ وَيُصَلَّى عَلَيْهِ (باب الجنائز : ص)
যদি কোন ব্যক্তি কারো জন্য জানাজার ওসিয়াত করে যায় কিন্তু উক্ত ব্যক্তির জানাজার সুযোগ না হয় তাহলে অন্য কেউ নামাজ পড়াতে পারে। উক্ত ওসিয়াত আদায় করা ওয়াজিব নয়।
যদি পুরাতন কবর ধসে যায় তাহলে তার উপর মাটি দিয়ে ঠিক করা জায়েজ আছে কিন্তু তার ভিতর থেকে কাঠ, বাঁশ, কাঁচা ইট ইত্যাদি বার করে মেরামত করা জায়েজ নয়। (দুরে মুখতার ১ম খণ্ড, পৃঃ ৫৮৪)
কবরে লাশ রাখার পর মুখ দেখান ঠিক নয়। তবে তার বাঁধন গুলো খুলে দেওয়া যায়।
জানাজা নামাজ একাধিক বার পড়া জায়েজ নয়। (দুঃ মুখতার, ১ম পৃঃ ৫৯২)
যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতার মধ্যে কাউকে হত্যা করল তার জানাজা পড়া হবে না।
لا يُصَلَّى عَلَى قَاتِلٍ أَحَدَ أَبويه (الدر المختار : ص )
যদি কবরে কোন বস্তু ছেড়ে যায় তাহলে কবর খুঁড়ে তা বার করা জায়েজ। (রদ্দুল মুহতার ৬০৩)
যদি কোন গর্ভবতী ইন্তেকাল করে আর তার পেটে বাচ্চা জীবিত থাকে তাহলে পেট কেটে তার বার করা হবে। (দুঃ মুহতার পৃঃ ৬০২)
মাটি জমানোর উদ্দেশ্যে কবরের উপর পানি ছড়ানো জায়েজ আছে। (দুরুল মুখতার- ৬০১)
যদি মুর্দার নোখে নোখ পালিস দেওয়া থাকে তাহলে তা ছাড়িয়ে গোসল দিতে হবে অন্যথায় গোসল জানাজা কিছুই সঠিক হবে না।
কবরে লাশের মুখ কিবলার দিকে করে দিতে হবে। মাইয়্যেতের ডান কাত করে শুইয়ে দেওয়া ভালো। (দুঃ মুখতার ৬০০)
ঈসালে ছওয়াব ও দওয়ার মজলিসের আকিদা
আহলে সুন্নাত অল জামায়াতের আকীদা যে, ইমানদার মোমেন মুসলমানের ইন্তেকালের পর তার রূহে ছওয়াব রেসানী করা জায়েজ। হাদীস পাকে হজরত আবু আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে রসুলুল্লাহ (সঃ) বলেন।
إِذَا تَصَدَّقَ أَحَدُكُمْ صَدَقَةً تَطَوُّعاً فَلْيَجْعَلُهَا عَنْ أَبَوَيْهِ فَيَكُونُ لَهُمَا أَجْرُهَا وَلَا يُنْقَصُ مِنْ أَجْرِهِ شَيْئاً (عمدة القارى: ص)
অর্থাৎ তোমাদের মধ্যে যখন কেউ নফল সাদকা করবে তখন ঐ সাদকা তার মা বাপের তরফ থেকে করবে তাহলে সাদকার বদলা তার মা বাপের জন্য হবে এবং সাদকা কারীর নিজস্ব ছওয়াবে কম করা হবে না। অর্থাৎ সাদকাকারীও পূর্ণ ছওয়াব পাবে।
উমদাতুল ক্বারী ১ম খণ্ড পৃঃ ৮৭৫ ইমাম খাত্তাবী (রঃ) বলেন কবরের কাছে কুরআন শরীফ তিলাওয়াৎ মুস্তাহাব হওয়ার এটা প্রমান দেওয়া হয় তাহলে কুরআন তেলাওয়াৎ তো তার থেকে বড় আজমত ও বরকতের বস্তু। অতএব যদি গাছের তসবীহের কারণে আজাব হাল্কা হওয়ার আশা করা যায় তাহলে তেলাওয়াৎ দ্বারা আশা করা আরো বেশি অধিকার রাখে।
হজরত আনাস (রাঃ) হতে মারফুয়ান বর্ণিত আছে যে যদি কেউ কবরস্থানে গিয়ে সুরা ইয়াসীন তেলাওয়াৎ করে আল্লাহ তায়ালা ঐ দিন কবর বাসীর আজাব কে হাল্কা করে দেন আর যে ব্যক্তি নিজ পিতা-মাতা অথবা দুজনের মধ্যে কারো কবর জিয়ারত করে সেথায় সুরা ইয়াসীন তেলাওয়াৎ করে আল্লাহ তায়ালা তাকে ক্ষমা করে দেন। (উমদাতুল ক্বারী, ১ম খণ্ড, পৃঃ ৮৭৫)
মোট কথা কোন মাইয়্যেতের নামে দোয়া-দরুদ, কুরআন শরীফের কোন সুরা বা আয়াত পাঠ করে তার ছওয়াব অথবা দান খায়রাত করে তার ছওয়াব মাইয়্যেতের রূহে পাঠালে মহান আল্লাহ তায়ালা নিজ দয়ায় ও মেহেরবানীতে তার রূহে পৌঁছে দেন।
তাই আমাদেরও উচিৎ হবে মাতা-পিতার কবর জিয়ারত করে, কবরের ধারে দাঁড়িয়ে কিছু ছওয়াব রেসানী করা।
আমাদের প্রতি সব থেকে বড় এহসান হল হুজুর পুর নূর (সঃ) এঁর, তাঁরই রেখে যাওয়া হিদায়াত ছিল বলে আজ আমরা মুসলমান বা ঈমানদার তাই তাঁর নামেও দোয়া, দরুদ, সালাম ও ছওয়াবের তোহফা পাঠানো আমাদের কর্তব্য।
প্রত্যেক দিন কবর জিয়ারাত জায়েজ আছে তবে বৃহঃ বার, শুক্রবার, শনিবার ও সোমবার জিয়ারাতের উত্তম দিন। (ফাতাওয়া আমিনিয়া ২য় ভাগ, ১ম পৃষ্টা)
মোবারক রাত গুলিতে যেমন- শবেকদর, শবেবরত, আশুরা, দুই ঈদ ইত্যাদি মাজার জিয়ারাত করা উত্তম।